উত্তরের বিভিন্ন গ্রামে একসময় বাঁশ শিল্পের জমজমাট ব্যবসা ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে সেই শিল্প। ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রবেশ করায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী বাঁশ শিল্প এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে।
রংপুর বিভাগীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প অধিদপ্তর জানায়, উত্তরের ৮ জেলার ১১৪টি গ্রামের মানুষ বাঁশ শিল্পে কর্মরত থেকে পরিবার-পরিজন পরিচালনা করত। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় দেশ ডিজিটাল এবং আধুনিকায়নের যুগে প্রবেশ করায় ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।
রংপুরের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার আবু জাফর জানান, একসময় বাঁশ শিল্পে এই অঞ্চলের ৭০ হাজার পরিবার তাদের জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু বর্তমানে এই শিল্পে কর্মরত রয়েছে মাত্র ১২ হাজার পরিবার। প্রতিদিনই কমছে এই শিল্পের ব্যবহার। তাই এই শিল্পের শিল্পীরা এখন পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছেন।
এই চিত্র শুধু রংপুরেই নয়, উত্তরের ৮ জেলা লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়েও। আধুনিকতার কারণে এসব জেলা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে বাঁশ শিল্প।
তবে বিসিকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শিল্পটি ধরে রাখতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, একসময় বাঁশ কাটার শব্দে মুখর থাকত রংপুরের গঙ্গাচড়ার বড়বিল ইউনিয়নের মনিরাম গ্রাম। গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে ছিল বাঁশের তৈরি হস্তশিল্প— ডালি, কুলা, ঝুড়ি, চাটাই, হাঁস-মুরগির টোপা, মাছ ধরার ফাঁদ, হাতপাখা থেকে শুরু করে নানা প্রয়োজনীয় ও নকশাদার সামগ্রী। এই শিল্পই ছিল গ্রামের অনেক পরিবারের একমাত্র জীবিকা। তবে আধুনিকতার স্রোতে হারিয়ে যেতে বসেছে শত বছরের এই ঐতিহ্য। এখন বাঁশের কাজ করা মানুষগুলো টিকে থাকার লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছেন।
মনিরামের প্রবীণ বাঁশশিল্পী আবদুল ওয়াহেদ (৮৫) বলেন, ‘আমার বাবার হাত ধরে এই কাজ শিখেছি। আগে অনেক অভাব-অনটন ছিল, এই কাজ করেই আমাদের ১৪ ভাই-বোনের সংসার চালাতেন বাবা। কখনোই হিমশিম খেতে হয়নি তাকে। বাবার আমল থেকে বাঁশের কাজ করছি। কিন্তু আগে যেমন বেচাবিক্রি হত, এখন আর সে রকম হয় না।’
নগরায়নের দৌঁড়ে পাল্লা দিয়ে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগছে বাংলাদেশের গ্রামগুলোতেও। ফলে গড়ে উঠছে নতুন নতুন জনবসতি। কমে যাচ্ছে কৃষি জমি ও বনাঞ্চল। গ্রামাঞ্চলে এখন বাঁশবন উজাড় করা হচ্ছে। তাই একদিকে বাড়ছে বাঁশের দাম, অন্যদিকে কমছে এর সহজলভ্যতা। ফলে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাঁশশিল্পীদের কর্মসংস্থানে।
মনিরামের বাঁশশিল্পী কেনজুল বলেন, ‘আগে বাঁশ শিল্পের সোনালী অতীত ছিল, এখন সেগুলো কেবলই গল্প। আগে বাঁশ পাওয়া যেত ৫০ থেকে ১০০ টাকায়। আর এখন কিনতে হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। একটা বাঁশ দিয়ে পাশ থেকে ছয়টি মুরগির টোপা তোলা সম্ভব। একটা টোপা আমরা পাইকারদের কাছে বিক্রি করি ১০০ টাকায়। তাহলে সারা দিন পরিশ্রম করেও আমাদের লাভ তেমন থাকে না।’